আজ আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব এমন একজন প্রতিভাবান মানুষকে যিনি আমদের দেশের গর্ব। তিনি একজন ক্ষুদে বিজ্ঞানি তৌহিদুল। তিনি একজন পলিথন প্রেমী শুনতে অবাক লাগলেও সেটাই সত্য। আমরা যে পলিথিন ফেলেদিন সে পলিথিন আমাদের পরিবেশের চরম ক্ষতি করে থাকে। পলিথিন মাটিতে বা পানিতে ফেলে দিলেও তা কোন দিনও পচে না অর্থাৎ পরিবেশের ক্ষতি করে।
আর ক্ষুদে বিজ্ঞানি তোহিদুল এই অপচনশীল পদার্থকে কাজে লাগিয়ে যেমন পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করছে সাথে পরিত্যাক্ত পলিথিন জাতিও জিনিস দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়াই তৈরী করছে জ্বলানি তেল। তা দিয়ে চালাচ্ছেন মটর বাইক, এবং এর ছাই থেকে তৈর করছে ফটোকপি মেশিনের কালি।আজকে তার সাথ কথা বলবো জানাবো কিভাবে তিনি এই কাজ করেছেন।
তৌহিদুলের কথায় ঘুরে-ফিরে একটি শব্দই এল আর তা হল পলিথিন,‘পরিত্যক্ত’,‘পুনর্ব্যবহার্য’ ইত্যাদি। প্রথমে পরিচয়ের শুরুতেই তৌহিদুল ইসলামের পায়ের কাছে থাকা বিস্কুটের প্যাকেট দেখিয়ে বলছিলেন, যে পলিথিন দেখছেন, এর ওজনের ৩৬-৪১ ভাগ জ্বালানি তেল উৎপাদন করা সম্ভব হবে। সেটার পাশেই পড়েছিল আরএকটি পলিথিনের ব্যাগ এই ব্যাগ থেকে কতটুকু জ্বালানি পাওয়া সম্ভব? তিনি বলেন ‘ওজনের প্রয় ৫৫-৫৮ ভাগ, কারণ এর মান অন্য পলিথিনের চেয়ে ভালো।
ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া পলিথিন নিয়েই দীর্ঘদিন যাবৎ গবেষনা করছেন তৌহিদুল ইসলাম। জামালপুরের ছেলে তরুণ তৌহিদুল ফেলে দেওয়া পলিথিনকে কাজে লাগিয়ে গাড়ির জন্য তেল তৈরি করেন জ্বলানি হিসেবে। বিষয়টি যে নতুন তা কিস্তু নয়, পৃথিবীর এমন অনেক দেশেই এমন কাজের রয়েছে। তবে বাংলাদেশে পলিথিন জাতিও পদার্থ থেকে জ্বালানি তেল তৈরির ঘটনা এটাই প্রথম। শুধু জ্বলানি তেল নয়, জনাব ইসলাম গ্যাস ও ছাপার জন্য কালিও পেয়ে যান ওই একই পলিথিন ব্যবহার করে। পঁচিশ বছর বয়সী তৌহিদুল এ কাজের জন্য স্বীকৃতিও পেয়েছেন ইতিমধ্যে। গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন বিভাগে পদক ২০১৮ পায়েছেন।
জামালপুর বর্জ্য শোধনাগারের পৌরসভা পাশে ছোট খাট প্ল্যান্ট নির্মাণ করেছেন আমদের আজকের উদ্ভাবক। ইতিমধ্যে এখান থেকে প্রথমিক ভাবে ৯৫ লিটার জ্বলানি তেল, ১২ থেকে ১৯ লিটার LPG গ্যাস এবং কয়েক কেজি ছাপার কালি পাওয়া গিয়েছে । সেই জ্বালিনি তেল দিয়ে মটর বাইক চালিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। 100 কেজি বাতিল পলিথিন থেকে 70 লিটার জ্বালানি এবং 10 লিটার মিথেন গ্যাস ও 20 লিটার ছাপার কালি উৎপাদন সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
এত কিছু থাকতে পলিথিনই নিয়ে কেন গবেষনা বেছে নিলেন? তিনি বলেন আসলে ‘সত্যি বলতে, আমি এত কিছু ভেবে কাজ শুরু করিনি। প্রথম লক্ষ্য ছিল পলিথিন ধ্বংস করে পরিবেশ কে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা। সেটা করতে গিয়েই এই উদ্ভাবন চিন্তা আমার মাথায় আসে, বলে জানায় তৌহিদুল।
জামালপুর সদরে বসবাস করেন তিনি। বাড়ির এক কোনায় ফুলের বাগান করেছিলেন তৌহিদের মা কিন্তু বাড়িতে ফুলের গাছগুলো বড় হচ্ছিল না। কিন্তু কেন বড় হচ্ছে না? চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তৌহিদ এর সম্ভাব্য কারণ খুঁজতে শুরু করেন। দীর্ঘদিন চিন্তা ভাবনার পর বের করলেন গাছ বড় না হবার পেছনের কারন, বাগানে গাছের শেকড়গুলো পলিথিনের ভেতর জরিয়ে পাকিয়ে ছিল। ফলে মাটিতে ছড়াতে পারছে না তাই বড় হচ্ছিল না ।
জনাব বললেন, আমি শৈশবে একটু অন্য রকম ছিলাম। যে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে, পড়ে, নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে চেষ্টা করতে ভালো লাগত আনান্দ পেতাম। যে সকল খেলনা ছোট বেলায় হাতে পেলে, খেলার চেয়ে ভেঙে ভেতরটা দেখাতেই আগ্রহই থাকত সবচেয়ে বেশী। এ জন্য পাড়া প্রতিবেশীরা হাসাহাসি করত আমাকে পাগল বোকা ভাবতো, তাঁদের আদরের সন্তানদের আমার খেলার সাথিদের সাথে আমাকে মিশতে বা খেলতে দিতেন না। তাই আমার তেমন বন্ধু বান্ধব ছিল না। আমি নিজে নিজে খেলতাম আর ঘরের পুরাতন ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি নিয়ে গবেষনা করতাম। কোন বাড়িতে ইলেক্ট্রিক কাজ হলে সারাদিন বসে বসে দেখতাম এবং বিভিন্ন প্রশ্ন করে জানার চেষ্টা করতাম। কেউ বলতো আর বেশী ভাগ মিস্ত্রীরাই বিরক্ত বোধ করতো।
সমস্যা তো পাওয়া গেল, কিন্তু এখন সমাধান? এই বর্জ্যের বিকল্প ব্যবহারের উপায় খুঁজতেই থাকেন ছোট তৌহিদুল। পুড়িয়ে ধ্বংস করা যায়, তাতে পরিবেশের মারাত্বক ক্ষতি হয় তাই পলিথিন থেকে পরিবেশকে বাচাতে পলিথিন ধ্বংশ করার পরিবেশসম্মত সঠিক উপায় খোজার চেষ্টায় লেগে পড়েন।
রসায়ন বইয়ের পাতায় পাতায় মনোযোগ দিয়ে পড়েন। কোন সমস্যায় পড়লে রসায়ন বিভাগের প্রভাষক একরামুজ্জামানের কাছে যান নানা বিষয় নিয়ে জানতে। কলেজের স্যার বলেন, ‘কোনো সমস্যায় পড়লেই তৌহিদুল আমার কাছে আসত।প্রথমে বিজ্ঞান বিভাগের মাধ্যমেই ও কাজ শুরু করেছিল। ব্যবহারিক ক্লাসে এসে নানা বিষয় নিয়ে ওর ছিল প্রশ্ন। রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পলিথিন থেকে কী উৎপন্ন হয় এ বিষয়গুলো নিয়ে নানান প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইত। ল্যাবরেটরিতে কাজ করত। একসময় তো সফল হলো তই আজ ভাল লাগছে।
পলিথিন একধরনের হাইটেমপারড হাইড্রোকার্বন এটা সে জানতে পারে পড়ালেখা মাধ্যমে জেনতে পারে।এরপর নিজে নিজে বিভিন্ন পরীক্ষা চালান। কাচের নলের মধ্যে পলিথিন জাতিয় পদার্থ উচ্চ তাপে উত্তপ্ত করলেন। তাতে পরীক্ষার কাচের নলটি বিস্ফোরিত হলো। এমন বেশ কয়েকবার পরিক্ষা চালালেন। সফলতা এল একবার। দেখতে পেলেন, প্রচণ্ড গতিতে কাচের নল দিয়ে বাষ্প বের হচ্ছে, এরপর বাষ্প ঠান্ডা হয়ে পানির মতো বোতলে জমা হচ্ছে তা। পরে দেখা মনে হচ্ছিল ওই তরল তেলের মতো কিছু একটা তরল পদার্থ।
শুরুর গল্পটা এমনই ছিল। এর মধ্যে রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া সম্পর্কে আরও পড়াশোনা করতে থাকেন তিনি। ২০১১ সালে তিনি সফলভাবে প্রথমবার তেল উৎপাদন করতে সক্ষম হন তিনি। প্রথমে ইস্পাতের একটি বড় আকারের একটি সিলিন্ডা মতো দেখতে বস্তুতে পলিথিন দেন ওই প্রকোষ্ঠ বায়ুরোধী করেন। চেম্বারটিকে উচ্চ ৭৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে যখন উত্তপ্ত করা হয়, তখন পলিথিনের যে কার্বন ডাই-অক্সাইড চেইন আছে সেটা ভেঙে গিয়ে প্রচণ্ড চাপের বাষ্প হয়ে নল দিয়ে বের হয়। তাপে উত্তপ্ত করার পর নলের মাধ্যমে একসময় কালচে রঙের তরল বস্তু, মিথেন গ্যাস ও কালি বের হচ্ছিল। পলিথিন পুড়িয়ে পাওয়া এই জ্বালানি নানা কাজে ব্যবহার করা যায়।এই প্ল্যান্টে উৎপাদিত পেট্রল দিয়েই চলছে নিজের মোটরসাইকেল।
বিভিন্ন প্রকার উদ্ভাবনের জন্য ২০১০ সাল থেকে নানান পুরস্কারে পুরুস্কিত হয় তৌহিদুল। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্র ২০১৭ সালে জেলা, বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সরকারের ‘ডিজিটাল মেলায়’ অংশ নিয়ে শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবকের পুরস্কার হিসেবে ৬ লাখ বিশ হাজার টাকা পান তিনি। এছাড়াও ১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্ভাবকের খোঁজে প্রথম পুরুষ্কার পান তিনি। সেখান থেকে পুরস্কার হিসেবে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে ৫ লাখ টাকা এবং প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য আরও বিশ লাখ টাকা দেয়।এছাড়াও মে মাসে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইনোভেনশন, ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে পরিবেশ রক্ষা বিষয়ের উদ্ভাবনী কাজের জন্য স্বর্ণপদক পেয়েছেন আমাদের আজকের তৌহিদুল ইসলাম।
আবদুল মান্নান ও হালিমা খাতুনের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট তৌহিদুল। সরকারি ও বেসরকারী বিভিন্ন স্বীকৃতি ও পুরস্কার আরো কাজে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তৌহিদুল ইসলাম চান আরও বড় পরিসরে কাজটি এগিয়ে নিতে। তিনি তার গবেষনা জন্য তার মায়ের সোনার গহনা বিক্রি করে কাজ শুরু করেছিলেন।
আমরা এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সকলে ভেতরে লুকিয়ে থাকা মেধা ও চিন্তা বাস্তবে কাজে লাগিয়ে নাজের এবং দেশের উন্নতি একজন কর্ম হয়ে উঠতে পারি। চাকরির পেছনে পেছনে ঘুরে জীবন নষ্ট না করে নিজের মেধা টাকে কাজে লাগিয়ে নিজেই হয়ে উঠুন সফল উদ্যোক্তা।বলুন আমরা চাকরি করবো না চাকরি দিব
Tags
খবর